ফাহিম আবরার

প্রকৃতির সব রূপ ঢেলে সাজিয়ে দেওয়া মহেশখালী নামক দ্বীপে আমি কাটিয়েছি আমার জীবনের ১৫টি বছর। উপজেলা কমপ্লেক্সের মাঠ, বিল্ডিং’র ছাদ, বিশাল বাবুর দিঘী, আদিনাথের মেলাবাজার, হাইস্কুল প্রাঙ্গণ আমার শৈশব ও কৈশোরের দূরন্তপণার নীরব স্বাক্ষী। সরকারি কোয়ার্টারের আঙ্গিনায় লাগানো শিমুল, অর্জুন, পেয়ারা গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে। শুধু একটা জিনিষের পরিবর্তন হয়নি। সেটা হচ্ছে সেবাকে পণ্য হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ।

আমি রোদের আলোয় ঝলমল করতে দেখা মহেশখালীকে রাতের আধাঁরে নিমজ্জিত হতে দেখেছি। একটা সময় ধারণাই হয়ে গিয়েছিল দিনে আট বা দশ ঘন্টা কারেন্ট থাকবে না সেটাই বোধয় স্বাভাবিক। কারেন্টের পরে চোর ডাকাতের দৌরাত্ম্য। আমরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শিক্ষিত প্রজন্ম তাদের অধিকারের হাল ধরেছে। যার ফলাফল সাম্প্রতিক নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের দাবিতে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে মানববন্ধন। আমি স্বাগত জানাই যারা রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এই আন্দোলনে সফলভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আমি জানি না সেই আন্দোলন সফল হয়েছিল কিনা। তবে একটা অনিয়মের বিরুদ্ধে যদি একটা জাতি নিয়মিত মূখ বুঝে সহ্য করে যায়, তবে তাদের উপর আরো অনিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমি বলবো এই আন্দোলনের সবার প্রথম ও মূখ্য সফলতা ছিল আমাদের উপর আরো অনিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার সাহসিকতা কেউ করেনি। আমি জানি না বর্তমানে নিরবিচ্ছিন্ন না হলেও দৈনিক গড়ে আঠারো ঘন্টা বিদ্যুৎ এর পিছনে আপনাদের এই আন্দোলনের কিছুটা হলেও অবদান ছিল কিনা।

কেউ কি খেয়াল করেছেন কেউ যদি আমাদের ভাষা না বুঝে তবে আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের হেয়প্রতিপন্ন করার একটা জঘন্য মন মানসিকতা এখনো আমাদের ভিতর থেকে সরানো যায়নি। যার কুৎসিত বহিঃর্প্রকাশ হচ্ছে ঘাটে দেশী বিদেশী ট্যুরিস্টদের সাথে জঘন্য ভাষায় হাসি ঠাট্টা করা। আশেপাশে আমাদের মত তথাকথিত শিক্ষিত কেউ নিজেদের দেশী ভাইরা ট্যুরিস্টদের অপমান করছে দেখেও প্রতিবাদ করি না। কারণ নিজেদের মান সম্মানে আঘাত লাগলেও লাগতে পারে। কেউ খেয়াল করে দেখেনা ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে আমাদের এই দ্বীপের আছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু আমরা দশের স্বার্থ গায়ে মাখতে চাই না। আমরা ট্যুরিস্ট দেখলে ভাড়া হাকাই। সেটা হোক হোটেল, রিকশা কিংবা স্পীডবোট। যেখানে বিশ্বের বড় বড় ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ট্যুরিস্টদের বিভিন্নভাবে ডিস্কাউন্ট দিয়ে কিংবা অফার দিয়ে ট্যুরিস্ট টেনে নিচ্ছে সেখানে আমরা ওদের সাথে যতটুকু সম্ভব অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করি। মনে রাখবেন এখানে কিন্তু ওরা মাগনা ঘুরতে আসেনা। শুধু মাত্র দেশের ভেতর বলে এবং অনেকের পাসপোর্ট নেই বলে কক্সবাজার মহেশখালীতে এত বেশি ভীড়। নাহলে এর চেয়েও কম খরচে ইন্ডিয়া ইন্দোনেশিয়ার অনেক ওয়ার্ল্ডক্লাস সীবীচে ঘুরে আসা যায়। ওসব জায়গা যদি পাসপোর্টের জটিলতা এড়ানোর জন্য মত বিষয়গুলো একটু নজরদারিতে আনা হয় তবে দেখবেন আমাদের কক্সবাজারের কোন ভাত থাকবে না সিরিয়াসলি। টাকা আনতে হলে প্রফেশনালি আনতে হবে, ডাকাতি করে নয়। মনে রাখবেন হোটেল রুম যত সূলভ হয়ে যাবে, আমাদের আচার আচরণ যত ভাল হবে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেড়ে যাবে। জোর করে নয় কোয়ালিটি দিয়ে আন্তরিকতা দিয়ে ব্যবসা করতে হবে। আমরা কিন্তু ব্যবসাকে শুধু ব্যবসা হিসেবেই বুঝি। সার্ভিস মানে এই নয় যে আমি কাস্টমারকে ঠেকায় ফেলে টাকা আদায় করব। সার্ভিস মানে সেটা আমার ব্যবসার পাশাপাশি দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের অনেক বড়ভাই ও সতীর্থরা “Tourism & Hospitality Management” নিয়ে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তারা যদি এই অধমের ছোট্ট লেখাখানা নজর করেন তাহলে আপনাদের বলছি আপনারা নিজ উদ্যোগের মাধ্যমের ফোরাম তৈরি করে কিভাবে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তাসহ মহেশখালীর পর্যটন শিল্প উন্নত করা যায় এই ব্যাপারে এগিয়ে আসেন তাহলে মহেশখালী আক্ষরিক অর্থেই দ্বীপ কন্যা হয়ে উঠবে।

তবে এবার বাড়ি যাওয়ার পরে আরেকটি বিষয়ে অনেক বেশী পূলক অনুভব করেছি যে মহেশখালীতে এখন হাই স্পীড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চলে এসেছে। এই ইন্টারনেট এক্সেস করার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবে। এলাকার বেকার অনেক ভাইয়েরা আছেন যাদের টেকনিক্যাল নলেজ থাকা সত্ত্বেও ফ্রী ল্যান্সিং সহ বিভিন্ন কারিগরি কাজে আগাতে পারছেন না , তাদের এবার একটা গতি হবে ইনশাল্লাহ। তাছাড়াও এলাকার উন্নয়নার্থে আপনাদের মধ্যে অনেক এন্টারপ্রেণার স্বল্প মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স সহ ট্রেনিং সেন্টার খুলতে পারেন । বিশ্বাস করতে পারবেন না ইন্টারনেট এক্সেস করে শহরের ছেলেদের করা পড়ালেখার সাথে আমাদের মান্ধাতার আমলের পড়ালেখার আকাশ পাতাল তফাত (এই নিয়ে বিস্তারিত অন্যদিন লেখব)। মোবাইল ইন্টারনেটের সাথে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের এই পার্থক্য যে মোবাইল ইন্টারনেট রিলায়েবল না। এটা স্বল্প মেয়াদী বিনোদনের কাজে হয়ত ইউজ করা যেতে পারে। কিন্তু এডুকেশন পারপাস বা অফিসিয়াল ও প্রফেশনাল কাজ করতে গেলে আমাদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন বুঝি ডাটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট অনেকটা রিলায়েবল ও আনলিমিটেড রিসোর্স এক্সেস বিষয়ে কোন কার্পন্য করতে হয় না। আশা করি মহেশখালীর মানুষ হাই স্পীড ইন্টারনেট কানেক্টভিটিতে যোগ হয়ে উন্নয়নের শক্ত ভীত গড়ে তুলবেন। তবে আমি অবাক হয়েছি ইন্টারনেটের লাইন নেওয়ার সময় আমার শহরের কানেকশানের মত ফাইবার কস্ট দিতে হয়নি। জাস্ট ONU (optical to ethernet converter) এর দামটা দিয়েছি এবং রাউটারটা কিনেছি এবং দামসহ ইন্টারনেটটা খুব রিলায়েবল। তবে আমাদের প্রফেশনালিজম ও ব্রডব্যান্ড বিমুখতার কারণে ইন্টারনেট সেবাটি সেভাবে ছড়িতে পড়তে পারছে না। আমাদের ব্রডব্যান্ডের সর্বোচ্চ দৌড় হচ্ছে বিকালে কোন একটা হটস্পটে বসে মুভি বা গান ডাউনলোড দেওয়া। কোন শিক্ষণীয় কাজে আমরা এটি লাগাচ্ছি না। এক্ষেত্রে আমাদের উচিত কিভাবে সঠিকভাবে ইন্টারনেট রিসোর্সগুলো এক্সেস করতে হয় সেটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। মহেশখালীকে ডিজিটাল আইল্যান্ডে রুপান্তরিত করতে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য “Moheshkhali Net Link “ এর উদ্যোগতাদের স্বাগতম। তবে আমাদের ভেতর থেকে আরো উদ্যোক্তাকে সাহস করে বেরিয়ে “চাকরি করব নয়, চাকরি দেব” মটোতে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কয়েকটা প্রজেক্ট আইডিয়া আমিই দিতে পারি যেমন “ই কমার্সের মাধ্যমে মহেশখালীর চিংড়ি, শুটকি এগুলো রিজনেবল প্রাইজে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া (এক্ষেত্রে আপনাকে সততা মেন্টেন করে বিষ ছাড়া শুটকি রপ্তানি করতে হবে, ফলে আপনার কোম্পানির একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরী হবে)। বিশ্বাস করেন বা না করেন এই সব ব্যবসা আগুনের ফুল্কির মতো সারাদেশ ছড়িয়ে পড়বে। সাথে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান ও সৃষ্টি হবে। তাই চাকরির পেছনে হা-হুতাশ করে না দৌঁড়িয়ে নিজেই হয়ে যান চাকরিদাতা।

এবার শেষ একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই। যারা মহেশখালীর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা বা মহেশখালীকে সাপোর্ট দেওয়া যায় এমন অবস্থানে বসে কাজ করছেন , তাদের একটা স্ট্রং ফোরাম হওয়া প্রয়োজন। যারা বন্ধের সময় আসবেন, মিটিং হবে এবং সেখানে কিভাবে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হবে ডিবেট হবে, উদ্যোগ হবে। আশা করি বড় ভাইরা এই ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা করবেন।

 সাঈদ মোহাম্মদ ফাহিম আবরার, স্নাতক, তৃতীয় বর্ষ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল।